কোভিডের বিশাল ঢেউ ভারতের বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছে

ভারতে ভাইরাস আগের চেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। মেগাসিটি গুলোতে পূর্ববর্তী উচ্চ সংক্রমণের হার সত্ত্বেও এটি ঘটছে। বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে উচ্চ সংক্রমণের হার কিছুটা সুরক্ষা দেবে। তবে তা হয়নি। তাহলে কি ভুল হয়েছে?
স্মৃতি মল্লপাতি
ভারতে মহামারীটি এমন গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে যা বিজ্ঞানীদের স্তম্ভিত করেছে। মার্চের শুরু থেকেই প্রতিদিনের সংখ্যা বিস্ফোরিত হয়েছে। এর আগে, ১৮ এপ্রিল, সরকার দেশব্যাপী ২,৭৩,৮১০ নতুন সংক্রমণের খবর দিয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে, ভারতের উচ্চ সংখ্যারাই বিশ্বব্যাপী কেসগুলি দৈনিক সর্বোচ্চ ৮,৫৪,৮৫৫এ উন্নীত করেছে। এটি জানুয়ারিতে রেকর্ড সেট প্রায় ভেঙে দেয়।
মাত্র কয়েক মাস আগে অ্যান্টিবডি ডেটা পরামর্শ দিয়েছিল যে দিল্লি এবং চেন্নাইয়ের মতো শহরগুলিতে অনেক লোক ইতিমধ্যে সংক্রামিত ছিল। এটি কিছু গবেষককে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়েছে যে, দেশের মহামারীটির সবচেয়ে খারাপ পর্যায় অতিক্রান্ত হয়েছে।
ভারতের গবেষকরা এখন এই নজিরবিহীন উৎসের কারণ কী তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। তারা সন্দেহ করছেন যে, এটি বেশ কয়েকটি কারণে হতে পারে। তাদের তিনটি সন্দেহ প্রথমত, নতুন ভারিয়েন্ট, দ্বিতীয়ত, অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক যোগাযোগ এবং তৃতীয়ত, কম টিকাদান কাভারেজ।এই কারণগুলি খুঁজে বের করা বিশ্বজুড়ে সরকারকদের জন্যে জরুরী। কারণ সকল সরকার জানতে চায় তাদের নিজ দেশে অনুরূপ প্রাদুর্ভাবকে দমন কিভাবে করতে হবে।
ফ্রান্স ও জার্মানির মতো ইউরোপীয় দেশগুলিতেও বর্তমানে তাদের জনসংখ্যার আকারের অনুপাতে বড় প্রকোপ গুলো দেখা দিয়েছে। ব্রাজিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য দেশগুলি সংক্রমণের উচ্চ হারে রয়েছে। তবে ভারতের দৈনিক আক্রান্তের হার এখন যে কোনও দেশের জন্য রেকর্ড সর্বোচ্চ। ২ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড করা ৩,০০,০০০ সংক্রমণ থেকে ভারতের বর্তমান হার খুব বেশি দূরে নয়।
বাথটাবে ঢেঊ
ভারতে কোভিড -১৯ এর সংক্রমণের সংখ্যা গত সেপ্টেম্বরে কমতে শুরু করে। সেই সময়ে দৈনিক সংক্রমণ ১০০০০০ এসেছিল। তবে মার্চে তা আবার উঠতে শুরু করে। বর্তমানের সংক্রমণের হার পূর্বের হারের দ্বিগুণের চেয়ে বেশী ।
মুম্বাইয়ের পি ডি হিন্দুজা হাসপাতাল ও মেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের ক্লিনিকাল রিসার্চ পালমোনোলজিস্ট জেরির উদ্ওয়াদিয়া বলেছেন, ” প্রথম তরঙ্গটিকে দ্বিতীয় তরঙ্গের তুলনায় বাথটাবে একটি ঢেউয়ের মতো দেখাচ্ছে।” নিবিড় পরিচর্যা কাজের বিরতিতে তিনি নেচার ম্যাগাজিনের সাথে কথা বলেছেন। তিনি হাসপাতালগুলিতে একটি “দুঃস্বপ্ন” পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন। বিছানা এবং চিকিত্সা এখন তার হাসপাতালে এখন অত্যন্ত দুর্লভ।
সোনিপটের অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট শহীদ জামিল বর্তমান তরঙ্গের তীব্রতা ভয়াবহ বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি সংক্রমণের নতুন তরঙ্গ আশা করছিলাম, তবে আমি কখনই ভাবিনি যে এটি এত শক্তিশালী হবে।”
অ্যান্টিবডি টেস্ট সংক্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ভারতে ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে এন্টিবডি সমীক্ষা করা হয়েছিল। সেই সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে যে ৫০% এরও বেশি জনসংখ্যা – বিশেষত ভারতের প্রধান কয়েকটি শহরগুলিতে ইতিমধ্যে ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছে। এই কাজটির নেতৃত্বদানকারী চেন্নাইয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলজির একজন মহামারী বিশেষজ্ঞ মনোজ মুুরেকার বলেছেন, “এন্টিবডির যে হার আমরা দেখতে পেয়েছি তার ভিত্তিতে, তাত্ত্বিকভাবে নতুন সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা নয়। “।
তাদের গবেষণায় আরও বোঝা যায় যে, সারা দেশে প্রায় ২৭১ মিলিয়ন মানুষ সংক্রামিত হয়েছে। এটি ভারতের ১.৪ বিলিয়ন মানুষের প্রায় পঞ্চমাংশ।
এই সংখ্যাগুলি কিছু গবেষককে আশাবাদী করে তুলেছিল। । তারা আশা করেছিল যে মহামারীটির পরবর্তী ধাপটি কম তীব্র হবে, তবে সাম্প্রতিক কভিড-১৯ এর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব তাদেরকে পূর্ব সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করছে।
একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে, প্রথম ঢেউটি বিশেষত শহুরে দরিদ্রদের উপর আঘাত হানে। কিন্তু টেস্ট গুলোর স্যাম্পল বাছাই এর সময়ে এই দুর্বলতাটি চোখে পরে নাই। তার ফলে অ্যান্টিবডির ভিত্তিক স্টাডি গুলো পুরো জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে নাই। ফলাফল হিসেবে বেশ কিছু জন গোষ্ঠীতে এন্টিবডির অভাবটি , সেই সব গবেষণায় উঠে আসে নাই।
ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিকেল কলেজের একজন ভাইরোলজিস্ট গগনদীপ কং একমত হন যে, অ্যান্টিবডি ডেটা ভাইরাসের অসম ছড়িয়ে পড়া প্রতিফলিত করে না। তিনি বলেছেন: “ভাইরাস জনসংখ্যার এমন সব জন গোষ্ঠীতে প্রবেশ করেছে যারা পূর্বে নিজেদের সুরক্ষায় সক্ষম ছিল”। এর মধ্যে নগরের সচ্ছল সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে যারা প্রথম তরঙ্গের সময় নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু, দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় তারা সামাজিক দূরত্ব রক্ষা না করে, মাস্ক ব্যতিত স্বাভাবিক ভাবে চলা ফেরা শুরু করেছিল।
দ্রুত পরিবর্তনশীল ধরন কি এই ঢেউয়ের জন্য দায়ী?
তবে কিছু গবেষক বলেছেন যে বর্তমান প্রাদুর্ভাবের গতি এবং প্রবণতা একটি নতুন উপাদানকে চিহ্নিত করেছেন ।তারা বলেন ভাইরাসটির নতুন ভ্যারিয়েন্ট গুলো সাম্প্রতিক উল্লম্ফনের কারণ হতে পারে।
উদওয়াদিয়া পর্যবেক্ষণ করেছেন যে , সাম্প্রতিক কালে পুরো পরিবার সংক্রামিত হচ্ছে । কভিড -১৯
এর প্রথম তরঙ্গের ক্ষেত্রে এটি ছিল না। তিনি বলেন, “পরিবারের কোনও ব্যক্তির যদি এটি থাকে তবে আমি গ্যারান্টি দিতে পারি যে পরিবারের প্রত্যেকের কাছে এটি থাকবে।” কিন্তু পূর্বের ভ্যেরিয়েন্টের ক্ষেত্রে এইটা দেখা যায় নি। তার মানে নতুন ভ্যারিয়েনট গুলো অনেক বেশী সংক্রামক।
জিনোমিক তথ্য দেখায় যে, B 1.1.7 ভ্যারিয়েন্ট ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে প্রধান সংক্রমণে পরিণত হয়েছে।
B 1.617 মহারাষ্ট্র রাজ্যে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। গত বছরের শেষ দিকে ভারতে তাকে প্রথম সনাক্ত করা হয়েছিল।
B 1.617 মনোযোগ আকর্ষণ করেছে কারণ এতে দুটি রূপান্তর রয়েছে। এই রূপান্তরগুলোর সংক্রমণের হার অনেক বেশী। কারণ এই ভারিয়েন্ট গুলোর টিকার এন্টিবডির বা পূর্বের সংক্রমণ থেকে সৃষ্ট এন্টিবডির সুরক্ষা এড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে। এ ভারিয়েন্টটি এখন পর্যন্ত আরো ২০ টি দেশে পাওয়া গেছে। ভারতের গবেষণাগারগুলি এটি শনাক্ত করার চেষ্টা করছে। ল্যাবগুলি পরীক্ষা করছে, এই ভ্যারিয়েন্ট কত দ্রুত প্রতিলিপি তৈরি করে। তারা গবেষণা করে বোঝার চেষ্টা করছে, যে টিকা দেওয়া হয়েছে তাদের এন্টিবডি নতুন সংক্রমণকে আটকাতে পারে কিনা।
গত বছরের শেষে ব্রাজিলে ভারতের পরিস্থিতি একই রকম ছিল । ব্রাজিলে, মানাউস শহরে কভিড ১৯ এর পুনরাবৃত্তি পি ১হিসাবে পরিচিত। একটি অতি দ্রুত সংক্রমণযোগ্য ছিল। । এই ভ্যারিয়েন্ট পূর্ববর্তী স্ট্রেনগুলির সাথে সংক্রমণের দ্বারা প্রদত্ত এন্টিবডিকে ছিন্ন করতে সক্ষম ছিল।
তবে অন্যরা বলছেন যে সিকোয়েন্সিং থেকে প্রাপ্ত ডেটা থেকে এই দাবি করার জন্যে পর্যাপ্ত প্রমান নেই। যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট ডেভিড রবার্টসন বলেছেন: “প্রাপ্ত সিকোয়েন্সগুলির সংখ্যা ভারতে সংক্রমণ সংখ্যার তুলনায় খুব কম। তাই ভারতের সাম্প্রতিক উত্থানের পেছনে ভারিয়েন্টকে দায়ি করার এই সিদ্ধান্তটি সম্পর্কে খুব সতর্ক থাকতে হবে।”
মেলামেশা, চলাচল এবং ভ্রমণ
কেউ কেউ বলেছেন যে উদীয়মান ভ্যারিয়েন্ট গুলো ভারতে সংক্রমণের বৃদ্ধির এক সামান্য অংশ মাত্র। অনুরাগ আগারওয়াল, নয়াদিল্লির সিএসআইআর ইনস্টিটিউট অফ জিনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি’র পরিচালক, অনেক অঞ্চলের প্রাদুর্ভাবে বেশিরভাগ জিনোম সিকোয়েন্সড করা হয় নাই ।
নয়াদিল্লিতে ভারতের জনস্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন এর মহামারী বিশেষজ্ঞ এবং পরিচালক শ্রীননাথ রেড্ডি যুক্তি দেখিয়েছেন যে মানুষের অবহেলা একটি বড় চালক। তিনি বলেছিলেন, “মহামারীটি অসচেতনতার কারনে সমাজে আবারো উদ্ভূত হয়েছে। কারণ ,সমাজে মানুষের মেলামেশা বৃদ্ধি পেয়েছে।মানুষ আবার কোন ধরনের প্রতিরক্ষা বাদে চলাফেরা করছে।
লক্ষ্মীনারায়ণ বলেছেন, গত বছরের সেপ্টেম্বরে সংক্রমণের পরিমাণ শীর্ষ থেকে নেমে যাওয়ার পরে, সাম্প্রতিক মাসগুলিতে, রাজনৈতিক সমাবেশ, ধর্মীয় উদযাপন এবং বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য বিশাল জনতা বাড়ির অভ্যন্তরে এবং বাইরে জড়ো হয়েছে।
লক্ষ্মীনারায়ণ আরও বলেছেন,জানুয়ারিতে শুরু হওয়া দেশব্যাপী টিকাদান অভিযান কভিডের বিস্তার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। টিকার ফলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাগুলি শিথিল হয় এবং টিকা নেওয়ার পড়ে সবাই অনিরাপদ মেজাজে ফিরে গেছে। ”
ভারতে ১২০ মিলিয়নেরও বেশি ডোজ টিকা পরিচালনা করা হয়েছে। বেশিরভাগ ভ্যাকসিন ভারতে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের কোভিশিল্ড সংস্করণ থেকে আসে। কিন্তু টিকার পরিমাণ ভারতীয় জনসংখ্যার ১০% এরও কম। তাই এখনও অনেক দীর্ঘ পথ যেতে হবে। তিনি বলেছেন, বিশেষ করে সবচেয়ে সংক্রমিত অঞ্চলে টিকার সংখ্যা বাড়ানো দরকার।
উদ্বাদিয়া বলেছেন যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে টিকা দেওয়ার সময়েই সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে । টিকা নেওয়ার সময়ে হসপিটালের ওয়েটিং রুমে প্রায়শই অসুস্থ ব্যক্তিদের সাথে সুস্থ ব্যক্তিদের মেলা মেশা হয়েছে। এর ফলেও সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
“নেচার সাময়িকীর প্রতিবেদন থেকে অনুদিত ” ।