সর্বধর্মীয় সহাবস্থানঃ সেকুলারিজম প্রশ্নের তাত্ত্বিক মীমাংসা

যাজকতন্ত্র ও সেকুলারিজম আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট
সেকুলারিজম একটি ইউরোপীয় শাসনতান্ত্রিক মতবাদ। অনেকের হয়ত অনুমান সেকুলারিজম একটি মতাদর্শ হিসেবে আগে হাজির হয়েছে, পরে সেই মতাদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয়রা ধর্ম থেকে দূরে সড়ে গেছে। আসলে বিষয়টি অত সরল ছিল না। বরং সাধারনভাবে বলা যায় ইউরোপীয়ানরা ধর্মকে কেন্দ্র করে তর্ক, বিতর্ক, সংস্কার আন্দোলন, সংস্কার বিরোধী আন্দোলন, ভিন্নমতের প্রতি নিপীড়ন ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সেকুলারিজমে এসে হাজির হয়েছে।
মধ্যযুগে খ্রিষ্টধর্মের প্রধান ধারা ক্যাথলিজমের ধর্মীয় গুরুরা গির্জার ধর্মীয় প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিজেদেরকে ‘ইশ্বরের প্রতিনিধি’ দাবী করে এক ধরণের ক্ষমতার চর্চা করত, যাকে ‘যাজকতন্ত্র’ (Theocracy বা পুরোহিততন্ত্র) বলে। শাসকদের ওপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে খ্রিষ্ট ধর্মের নামে যে সীমাহীন অত্যাচার ও নিপীড়নের শাসন কায়েম হয়েছিল তাতে মানুষজন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এই অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে প্রথম প্রতিবাদ আসে ধর্মতাত্ত্বিকদের মধ্য থেকেই। ‘মার্টিন লুথার’ নামে একজন জার্মান ক্যাথলিক ধর্মযাজক ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক সর্বপ্রথম রোমান ক্যাথলিক পুরোহিততন্ত্রের সমালোচনা করে লিখেন তাঁর বিখ্যাত ‘৯৫ থিসিস’। এই লেখার মাধ্যমে ইউরোপীয়ানদের চিন্তার রাজ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ইউরোপীয়ানরা দেখল ধর্মীয় ব্যাখ্যার মাধ্যমেই যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা যায়। শুরু হয় প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন।
মার্টিন লুথার স্রষ্টার একচ্ছত্র ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন। তবে তিনি বাইবেলের রেফারেন্সেই ‘ইশ্বরের রাজ'(Kingdom of God) এবং ‘দুনিয়ার রাজ’ (Earthly Kingdom) এর মধ্যে পার্থক্য করেন। পরবর্তীতে তার অনুসারীরা এই ধারনাকে আরো বিস্তৃত করেন। যেমন, ফ্রান্সের প্রোটেস্টেন্ট আন্দোলনের আরেক শীর্ষ ধর্মতাত্ত্বিক জন কেলভিন বাইবেলের রেফারেন্স দিয়েই ‘ইশ্বরের রাজ'(Kingdom of God) এবং ‘মানুষের রাজ’ (Civil Government) এর মধ্যে পার্থক্য করেন। বস্তুত, রোমান ক্যাথলিক যাজকতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিত মতবাদ ‘ইশ্বরের রাজ'(Kingdom of God) থেকে দুনিয়ায় মানুষের এজেন্সিকে প্রতিষ্ঠিত করার যে বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা ইউরোপীয়ানরা দেখিয়েছে সেটার ধারাবাহিকতাই হলো সেকুলারিজম।
যাত্রার শুরুটা স্রেফ ধর্মতাত্ত্বিক হলেও পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে ইউরোপ প্রত্যক্ষ করে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। একই সাথে ক্যাথলিক গির্জা ছিল বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক। এই ভুসম্পত্তির দখল নিয়েও কোথাও কোথাও গির্জা ও শাসক রাজার সাথে দ্বন্দ্ব বাঁধে, চলে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ। আধুনিকতার ঊষালগ্নে পুরো ইউরোপজুরে যত যুদ্ধ হয়েছে তাঁর একটা চিত্র ইমেজে দৃশ্যমান। রোমান ক্যাথলিক গির্জার (‘ইশ্বরের রাজ’-Kingdom of God) তত্ত্বের বিরুদ্ধে ‘মানুষের রাজ’ (Civil Government) প্রতিষ্ঠার পক্ষের লোকদের মধ্যকার ক্ষমতার লড়াই ও দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে সেকুলারিজমের আবির্ভাব ঘটে। মতবাদ আকারে সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই ইউরোপে চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। এটাকে প্রোটেস্টেন্ট আন্দোলনের সফলতা বা ফলাফল বলা যেতে পারে।
সেকুলারিজমঃ সংজ্ঞার সংকট
আপাতদৃষ্টিতে সেকুলারিজমের প্রয়োজন এ জন্য যাতে এক ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর প্রাধান্য লাভ না করে। কিন্তু ইউরোপে সবাই ছিল খ্রিষ্টান। ঝগড়াটা এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের ছিল না; ঝগড়া ছিল খ্রিষ্টধর্মের বিভিন্ন উপদল বা সিলসিলার মধ্যে। ক্যাথলিজম ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান ফির্কার মধ্যে। ইউরোপের ইতিহাস বলে সেকুলারিজম সেখানে মানব জীবন রক্ষার জন্য জরুরী হয়ে উঠেছিল। ইউরোপিয়ানদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে সেকুলারিজমের কাছাকাছি বাংলা অর্থ হতে পারে ‘ইহজাগতিকতাবাদ’। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে ইংরেজি সেকুলারিজমের বাংলা ‘অনুবাদ’ করা হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, যা একটি প্রশ্ন সাপেক্ষ অনুবাদ। কোন মতবাদের এই ধরণের শাব্দিক অনুবাদ স্পষ্টত বিভ্রান্তি। ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার সেকুলারিজমের আরো সুনির্দিষ্ট বাংলা অনুবাদ হতে পারত ‘ফির্কা-নিরপেক্ষতাবাদ’।
সেকুলারিজমকে একটা সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা সমস্যাজনক। কারণ রাষ্ট্রভেদে এই তত্ত্ব চর্চায় রয়েছে ভিন্নতা। অভিধান ধরে কোন তত্ত্ব বা মতবাদকে সংজ্ঞায়িত করার সংকট হচ্ছে এটি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে আমলে নেয় না। উদাহরণস্বরূপ, ঐতিহাসিকভাবে ফ্রান্সের সেকুলারিজম হচ্ছে অনেকটা ধর্ম-বিদ্বেষী (যাকে অনেকে Hard secularism বলে থাকেন)। কিন্তু আমেরিকা বা ইউকের সেকুলারিজম হচ্ছে ধর্মের ব্যাপারে সহনশীল (যাকে অনেকে Soft secularism বলেন)। ফ্রান্স প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে, ধর্মীয় প্রভাব থেকে রাষ্ট্রীয় পলিসি ও প্রতিষ্ঠানকে আলাদা করতে যে পরিভাষা ব্যবহার করে সেটি সেকুলারিজম নয়, তাকে বলে Laicity or Laicism। ফরাসীদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার কারনেই এটা ঘটেছে। সাধারণভাবে এ কথা বলা যায়, কোন জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক অভিজ্ঞতায় শাসন ক্ষমতার সাথে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্ব-সম্পর্কের আলোকে নির্ধারিত হয় সেকুলারিজমের সংজ্ঞা ও ধরন কি হবে। ফ্রান্স, আমেরিকা এবং ব্রিটেনের মধ্যকার সেকুলারিজমের চর্চার পার্থক্য সেটাই নির্দেশ করে।
বাংলাদেশের জমিনে সেকুলারিজম
আমাদের জমিনে সেকুলারিজমের সাথে পরিচয় ঘটে ব্রিটিশ উপনিবেশের হাত ধরে। উপনিবেশ আমাদের এখানে ইউরোপিয়ান রাষ্ট্র, মতবাদ ও প্রতিষ্ঠানের ধারণা হাজির করে। লক্ষ্য করবার বিষয় হল, উপনিবেশিক শাসনে সরকারের মডেল ছিল রাজতান্ত্রিক। সাম্রজ্যের প্রজা হিসেবে ভারতীয়দের মধ্যে সেকুলারিজম প্রশ্ন সেভাবে আসেনি। উপনিবেশ উত্তর সময়ে ইউরোপীয়ান রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের ধারণার আলোকে জাতিরাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় সেকুলারিজম হাজির হয়। ইউরোপে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠিত হবার মধ্য দিয়ে যেখানে সেকুলারিজম প্রশ্নের একপ্রকার মীমাংসা ঘটেছে, সেখানে আমাদের এখানে রাষ্ট্র গঠিত হবার আগেই দার্শনিক মতবাদ আকারে সেকুলারিজম হাজির হয়। আমাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা আর ইউরোপীয়ান ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এক না হওয়া স্বত্বেও দেশীয়দের মাঝে এই মতবাদকে কেন্দ্র করে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা শুরু হয়।
আমাদের জমিনে তাত্ত্বিক সেকুলারিজমের সাথে চর্চা ও প্রয়োগের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ নিজ নিজ রাজনৈতিক অবস্থান থেকে এর ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। ইসলামপন্থীরা সেকুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে ‘ধর্মহীনতা’ হিসেবে ক্যাম্পেইন করেন। এটা করার একটা ঐতিহাসিক কারনও আছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সেকুলারিজমের নামে অতি উৎসাহী কতিপয় বাঙালী জাতীয়তাবাদীর ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কতক পদক্ষেপের কারনে মানুষের মাঝে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের লেখায় উগ্র জাতীয়তাবাদীদের কিছু পদক্ষেপ উঠে আসে। তিনি দেখতে পান, স্বাধীনতার পর পর প্রবাসী সরকার ভারত থেকে ঢাকায় ফিরেই ‘‘যা দেখাইলেন, তাতে রেডিও-টেলিভিশনে কোরান-তেলাওয়াত, ‘খোদা হাফেয’, ‘সালামালেকুম’, বন্ধ হইয়া গেল। তার বদলে ‘সুপ্রভাত’, ‘শুভ সন্ধ্যা’, ‘শুভরাত্রি’ ইত্যাদি সম্বোধন প্রথা চালু হইল।মুসলমানদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হইল। গুজব রটিতে লাগিল, আযান নিষিদ্ধ হইয়া যাইবে।” (১)
তবে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন আবুল মনসুর। তিনি লিখেন, ‘’শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আশু প্রয়োজনীয় ঘোষণা করিয়াছিলেন যার একটি ছিল-আমি মুসলমান; আমার বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র।‘’(২) শেখের এই বক্তব্যে কতিপয় বিভ্রান্তির অবসান ঘটেছে বলে আবুল মনসুর মনে করলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন মতাদর্শিক দল সেকুলারিজমের পক্ষে বিপক্ষে নিজস্ব ধারায় মতামত তৈরি করে গেছেন।
বাংলাদেশের কোন কোন বিশ্লেষক দাবী করেন যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের আগে বাংলাদেশে সেকুলারিজম কখনোই আলাপের বিষয় ছিল না। ভারত কর্তৃক প্রবাসী সরকারকে স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্যের শর্ত আকারে এটি এসেছিল। এই প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিলেও কোনভাবেই স্বাধীনতা উত্তর প্রথম সংবিধানে সেকুলারিজমের অন্তর্ভুক্তিকে অস্বীকার করা যায় না। দেখার বিষয় হচ্ছে, সেকুলারিজমকে (অনুবাদ-‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ) বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাগণ কিভাবে বুঝেছেন বা কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এক্ষেত্রে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান বলেন,
‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে; মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে; খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ- যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ যে তাকে প্রত্যাঘাত করবে, এ আমি বিশ্বাস করি।’ (৩)
১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর পুনরায় মরহুম শেখ মুজিব বলেন : ‘জনাব স্পীকার সাহেব, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। … ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরী, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এ সব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’(৪)
ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার পরিণতি সম্পর্কে মরহুম জিয়াউর রহমান বলেন, ”কোন রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে না। একটা অবদান থাকতে পারে। কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে কখনই রাজনীতি করা যেতে পারে না। আমাদের এখানেই অতীতে আমাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে যে ধর্মকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সময়ে যখনই রাজনীতি করা হয়েছিল সেটা বিফল হয়েছে। কারণ ধর্ম ধর্মই। আমাদের অনেকে আছে যারা আমাদের দেশে যে বিভিন্ন ধর্ম রয়েছে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেন। রাজনীতির রূপরেখা বানাতে চেষ্টা করেন এবং আমরা বার বার দেখেছি তারা বিফল হয়েছে।’’(৫)
অর্থাৎ, পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বেড়ে উঠা এবং রাজনীতি করা বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের কাছে ‘পাকিস্তান এক্সপেরিমেন্ট’ এর যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার আলোকেই তাঁরা সেকুলারিজমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এতে একদিকে ধর্মের প্রতি জনগোষ্ঠীর যে অনুরাগ ও আবেগ সেটার প্রতিফলন ঘটেছিল। অন্যদিকে ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহারকেও চিহ্নিত করা হয়েছিল, যাথাযথভাবেই।
সেকুলারিজমের তাত্ত্বিক মীমাংসা
সেকুলারিজম নিয়ে রক্ষণশীল ও ধর্মানুরাগী মুসলিমদের কারো কারো প্রশ্ন রয়েছে। তাঁদের অনেকেই অভিধানের সংজ্ঞা ধরে সেকুলারিজম বুঝার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ আবার ইউরোপীয় অভিজ্ঞতালব্ধ সেকুলারিজমের উদাহরণ টেনে একে ‘ধর্মহীন মতবাদ’ অভিধা দেয়ার চেষ্টা করেন। ধর্মতত্ত্ববিদ মরহুম ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর ইউরোপীয়ান অভিজ্ঞতার সেকুলারিজমকে আমলে নিয়ে বলেন, ‘’ধর্মরিপেক্ষতার দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, সকল ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, ধর্মকে সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ন্যায়বিচার, প্রশাসন, অর্থ ও রাষ্ট্রসংশিষ্ট ধর্মীয় বিধানগুলি বাতিল, অচল বা প্রয়োগঅযোগ্য বলে বিশ্বাস করা। প্রথম বিষয়টি ইসলাম নির্দেশিত ও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতি ও দ্বিতীয় বিষয়টি ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক ও কুফর।‘’(৬)
অর্থনীতিবিদ ও শীর্ষস্থানীয় সাবেক আমলা আকবর আলী খান লিখেন, ‘‘ইউরোপে দুটি প্রত্যয়ের ওপর ধর্মনিরপেক্ষতার শাসনতান্ত্রিক মতবাদ গড়ে ওঠে। প্রথম প্রত্যয় হলো, রাষ্ট্র হবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। জাগতিক ব্যাপারে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রাধান্য থাকবে না। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যে এ প্রত্যয় স্বীকৃতি লাভ করে। দ্বিতীয় প্রত্যয় হলো, সব ধর্ম ও বিশ্বাসের ব্যক্তিরা আইনের দৃষ্টিতে সমান। শুধু যারা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে, তারাই নয়, যারা আদৌ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না (অর্থাৎ নাস্তিক), তারাও এই সুযোগ পাবেন।’’(৭)
আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর ও আকবর আলী খানের বক্তব্য অনুসারে লক্ষ্যণীয় যে সেকুলারিজমের একটি উপাদানের ব্যাপারে দুইজনেরই একধরনের ঐক্যমত্য আছে। যে উপাদান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সেটা হচ্ছে-রাষ্ট্রীয় সকল বিষয় থেকে ধর্মকে বা ধর্মীয় প্রভাবকে বাদ দেয়ার বিষয়টি। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এই উপাদানের বক্তব্য ইউরোপ কেন্দ্রিক, ইউরোপের অভিজ্ঞতালব্ধ ও সেখানে চর্চিত। এর সাথে উপরে উল্লেখিত বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার সেকুলারিজমের রয়েছে বিস্তর ফারাক। বাংলাদেশে সেকুলারিজমের চর্চা নিয়ে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেন, “আমার বিভিন্ন লেখায় এবং বক্তৃতায় আমি বলেছি – এখানে সেক্যুলারিজম মানে ঠিক রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে মুক্ত করে ফেলা নয়। কিতাবী সেক্যুলারিজম এবং আওয়ামী লীগের সেক্যুলারিজম বা বিভিন্ন পার্টির সেক্যুলারিজম এক করে দেখা ঠিক হবে না। সেক্যুলারিজম শব্দ ডিকশনারীতে যাই থাকুক বা টেকনিক্যালি যাই হোক এখানে বাস্তবে ‘কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন করা হবে না’ এবং সেই সাথে সেকুলারিষ্টরা আমি সেক্যুলার এই কথার মধ্যে কোনো সংঘাত দেখা যায় না। অর্থাৎ তারা সেক্যুলারিজমকে মনে করে ধর্মীয় সহিঞ্চুতা। এখানে ধর্ম অসহিঞ্চু হবে না।”(৮)
তথাপি, বাংলাদেশে পাশ্চাত্য ভার্সনের সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠায় যারা আগ্রহী এবং যারা এর বিরোধী, উভয়ের কাছেই বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় চর্চিত সেকুলারিজমকে উদাহরণ হিসেবে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক অনিহা লক্ষ্যণীয়। এর অন্যতম কারণ দুই গ্রুপেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী নিজস্ব মতবাদের রাজনীতি। তাঁদের স্ব স্ব রাজনীতির প্রয়োজনেই অভিধানে সংজ্ঞায়িত সেকুলারিজম ও তাঁর ব্যাখ্যাকে সামনে আনতে দেখা যায়।
‘প্রচলিত আইন’ এর সাথে ‘ধর্মীয় আইনের’ অনুমান নির্ভর সংঘর্ষ উত্থাপন করেও সেকুলারিজম প্রমাণ করার তৎপরতা আমাদের এখানে লক্ষ্যণীয়। মতাদর্শতাড়িত এই তৎপরতার আরেকটি বক্তব্য হল দেশে ‘শরীয়াহ আইন কায়েম নাই’। আর এজন্য রাষ্ট্র স্যাকুলার হওয়াকে দায়ী বলে মনে করা যায়। এমন অনুমান থেকে কেউ কেউ রাষ্ট্রকে ‘ইসলাম বিরোধী’ ঘোষণা করেন। এক্ষেত্রে ধর্মতাত্ত্বিক মরহুম ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের অভিমত হল,‘’সমকালীন মুসলিম দেশগুলির অধিকাংশ আইনই ইসলামী বা ইসলাম সম্মত। কিছু আইন ইসলাম বিরোধী।‘’(৯) মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমীন সংগঠনের নেতা হাসান হুদাইবী বলেন,‘’ ‘মানব রচিত’ সকল আইনই ইসলাম বিরোধী নয়। মুসলিম দেশগুলিতে কিছু ঔপনিবেশিক আইন-কানুন রয়েছে যেগুলি ইসলাম বিরোধী, এছাড়া অধিকাংশ আইন ও বিচারপদ্ধতি ইসলাম সম্মত।‘’(১০) অর্থাৎ, ‘শরীয়াহ আইন কায়েম’ করার চিন্তা আসছে ‘শরীয়াহ কায়েম নাই’ ধরণের কতিপয় অনুমান ও তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে, যা কার্যত
ইসলামের প্রশ্নবিদ্ধ মতাদর্শিকরণ এবং রাজনৈতিক পাঠ।
ইউরোপে যেখানে ‘ইশ্বরের রাজ’ তত্ত্বের বিরুদ্ধে ‘মানুষের রাজ’ প্রতিষ্ঠার ফলে সেকুলারিজমের আবির্ভাব। ইসলামে ‘ইশ্বরের রাজ’ তত্ত্বের অনুপস্থিতি এবং ‘মানুষের রাজ’ শুরু থেকেই স্বীকৃত হওয়া স্বত্বেও ‘শরীয়াহ আইন কায়েম’ প্রশ্নে সেকুলারিজমকে প্রতিপক্ষ আকারে হাজির করা হয়েছে। কল্পনা করা হয় ‘শরীয়াহ আইন কায়েম’ করার মধ্য দিয়ে দুনিয়াতে ‘খোদার রাজ’ (‘হাকিমিয়্যা’) কায়েম হবে। কিন্তু, মুসলিম রাষ্ট্রের অধিকাংশ আইনই যদি ইসলাম সম্মত হয়, যেটা হাসান হুদাইবি বলেছেন, তাহলে বাকী অল্পকিছু আইন ‘ইসলাম বিরোধী’ হওয়ার কারনে কিভাবে ‘শরিয়াহ কায়েম নাই’ বলা যেতে পারে?
বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে সকল ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র এখানে উদার। বর্তমান সংবিধানে ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ হিসেবে ইসলামকে ঘোষণার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি এবং প্রচ্ছন্নভাবে ধর্ম বিরোধী কোন আইন না করার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা উত্তর প্রথম সরকার কর্তৃক ‘ইসলামী ফাউন্ডেশন’ তৈরি হয়। যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইসলামের মর্মবাণী জনগোষ্ঠীর মাঝে পৌঁছানো। পরবর্তীতে ‘ধর্ম মন্ত্রনালয়’ সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্র কর্তৃক সকল ধর্মের নাগরিক ও ধর্মীয় উপাসনালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করা হয়। এসব প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতায় সেকুলারিজমের চর্চা প্রকৃত অর্থেই সকল ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করেছে।
প্রশ্ন হল, সকল ধর্মের মানুষের সহাবস্থান ও সমঅধিকার প্রশ্নে ধর্মনিরপেক্ষতা কি ইসলাম বিরোধী? বিশিষ্ট দেওবন্দি আলেম মুফতি আজিজুল হক আল-মাদানী বলেন- “আমি কসম করে বলবো, ধর্মহীনতার নীতি কুফরী মতবাদ, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা কুফরী মতবাদ নয়, এটা ইসলামী মতবাদ। ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষতার দল। ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষতার ধর্ম।”(১১) অর্থাৎ, কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আগেই যেটা উল্লেখিত হয়েছে, সেকুলারিজমকে একক বর্গে বা অভিধান ধরে সংজ্ঞায়িত করা সমস্যাজনক। কোন মতবাদকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না
উপনিবেশিক সময়ে বিভিন্ন ধর্মের ক্ষমতাকাঙ্খী মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগীতা ছিল। ধর্মীয় পরিচয়ের কারনে মানুষ নির্যাতিতও হত। কিন্তু ১৯৪৭ সালের আজাদী এবং মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবার পর প্রেক্ষাপটের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার আবশ্যিক ফলাফল হিসেবে দেখা গেল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সমীকরণে ধর্মের অনুপস্থিতি। এখানে কখনোই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে মসজিদ বা মাদ্রাসা রাষ্ট্র শাসন করেনি। ধর্মীয় গুরু বা ইমামরাও শাসনে সেভাবে জড়িত নয়। এখনকার দ্বন্দ্ব ধর্মের সাথে ধর্মের না, মূলত মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক।
ধর্মীয় যাজকতন্ত্রের সাথে সিভিল রাজতন্ত্রের দ্বন্দ্বের যে প্রেক্ষাপটে ইউরোপে সেকুলারিজমের উত্থান, সেই প্রেক্ষাপট আমাদের জন্য অপ্রাসঙ্গিক। তবে, উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ‘সকল ধর্মের সহাবস্থান’, ‘সকল ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা’, ‘সকল ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা’ এবং ‘বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার’ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এসব নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে সকল প্রকার ‘ধর্মীয় আধিপত্য’,‘পুরোহীততন্ত্র বা থিওক্রেসি মুক্ত’ হওয়াও জরুরী। এই অর্থে সেকুলারিজম আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থারই একটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। তবে সেকুলারিজমের বাংলা সমার্থক পরিভাষা হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ বিভ্রান্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য। এক্ষেত্রে বাংলা পরিভাষা হতে পারে ‘সর্বধর্মীয়সমতা’ বা ‘সর্বধর্মীয় সহাবস্তান’, যা আমাদের ইতিহাস, কালচার, ঐতিহ্য এবং অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যশীল।
——- নাজমুল হাসান
রেফারেন্সঃ
(১) আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাব মহল, ১৯৯৯, পৃ: ৫৯৩-৫৯৪,
(২) আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর
(৩) বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃ. ৩২
(৪) বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃ ৪৬
(৫) ১৯৮০ সালে বিএনপি নেতা-কর্মিদের এক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে ‘প্রশিক্ষিত কর্মীই রাজনৈতিক দলের প্রাণ’ শিরোনামে জিয়াউর রাহমান এর ভাষণ।[এমাজুদ্দীন আহামেদ ও অন্যান্য (সম্পাদিত), তারেক রহমান: অপেক্ষায় বাংলাদেশ, জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশান, ঢাকা, ২০১০, পৃষ্ঠা ৩৮৯]
(৬) আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ, পৃ. ১৬১
(৭) আকবর আলী খান, ‘অবাক বাংলাদেশঃ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৭
(৮) শাহ আবদুল হান্নান, ‘আমার কাল আমার চিন্তা’, কামিয়াব প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৯
(৯) আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ‘ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ’, আস-সুন্নাহ পাবলিকেশনস, ২য় সংস্করণ, ঝিনাইদহ, পৃ.১৭৫
(১০) ড. হাসান হুদাইবী, দুআতুন লা কুদাত, উদৃত আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ, পৃ.১৫৯
(১১) মুফতি আজিজুল হক আল-মাদানী, ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদ ইসলামী মতবাদ, ইউটিউব ভিডিও, ২২ মে ২০২০,https://www.youtube.com/watch?v=f92FOIvS7l4
[ ড্রাফট, সর্বশেষ সম্পাদিত, ২০.০৮.২০২০, লন্ডন]পাশ্চাত্যে সেকুলারিজমের দার্শনিক দিক পরিবর্তন ও আমাদের বাস্তবতায় সেটার অনুপস্থিতি নিয়ে আমার একটি প্রাসঙ্গিক আলোচনার লিংক,https://www.facebook.com/nazmul1985/videos/10224451150324951